আবার বৈশাখ যদি বাঙালির দেশে
সৈয়দ শামসুল হক | তারিখ: ১৪-০৪-২০১২
খরার চৈত্রের শেষে পহেলা বৈশাখে
গাঢ় এক অভিপ্রায়ে আমাদের প্রভূত আশায়
যখন এ দেশ তার সবুজ প্রথম এক সোনারোদ পায়
তখন হঠাৎ স্বর পেয়ে যায় শোলার বৈশাখ পাখি,
ডেকে ওঠে নদীপাড়ে আবার মেলায়
আমাদের ভুলে যাওয়া ডাকনাম ধরে ডাকে
আলতা মাখানো তার গাঢ় লাল ঠোঁটে!
তখন স্মৃতির ভিড় ঠেলে ওঠে
কবেকার লাল বহি হালখাতা সিঁদুরের মুদ্রাছাপ নিয়ে!
আমিও তখন কালঘুম থেকে জেগে উঠে জলসোঁতে গিয়ে
দাঁড়াই, জিজ্ঞাসা করি তুমি কি হে সেই নদী,
ইতিহাস-প্রসিদ্ধ নদীটি? হও যদি
তবে ভরে ওঠো তুমি প্রস্রবণের ঢলে আজ, তবে পুণ্য জলে
রাঁধন-হলুদমাখা আমাদের বধূটিকে ডাকো পুনরায়।
গাহনে শীতল যেন উঠে আসে আপন সংসারে—
যেন তব জলে বর মাটিমাখা হাতখানি ধুয়ে নিতে পারে,
যেন ঢেউ এসে লাগে পুনরায় নৌকোটির দাঁড়ে
গতিবেগ দিতে থাকে পারনের—আজও অভিলাষ
দূর স্বপ্নগ্রামে যায়—
যেন চোখ ফিরে পায় আবার গলুই তার,
যেন সেই অপার কাঠের চোখ দেখে ওঠে
ফসলের মাঠে মাঠে ধানের সম্ভার—
কবেকার নিবিড় সংসার সব—আবার—আবার।
মজে যাওয়া নদীটির তীরে এসে দাঁড়িয়েছি—এই ভোরে—
দেখেছি ভোরের রবি যদি আজ—বলি তাকে বড় স্তুতি করে,
তোমার রশ্মির লাল আলতার মতো যেন পুনরায়
বাংলার শ্রীমন্ত লক্ষ্মী আমাদের বধূদের চরণ রাঙায়
একদিন যারা ছাপ রেখে গিয়েছিল বাঙালির সম্পন্ন উঠানে;
পড়ে আছে বিমর্ষ লাঙল—
অচষা এখনো মাটি—মাঠে মাঠে—দিগন্তবিস্তারী—
কত নদী অপেক্ষায় দিতে হবে পাড়ি—
করতোয়া-বুকে ছিল জলের কল্লোল—
এখন সকলি গত—ইতিহাস জানে—
পদচিহ্ন পড়ে আছে—চৈত্রের খরায় পোড়ামাটির পাটায়—
পালযুগ কালের প্রত্নের মতো!—
কতদূর এসে গেছি এ পথ হাঁটায়!
খরার চৈত্রের শেষে নিদারুণ বিস্মৃতির পাড়ে
বৈশাখদিনের মেলা শুরু হয় করোটির ভেতর পাথারে।
আর সেই শোলার পাখিরা হঠাৎ সূর্যের লাল পাখায় পাখায়
মেখে নিয়ে জাদুবলে যেন উড়ে যায়,
স্বপ্নের সীমান্ত ছুঁয়ে খাল দহ ভেঙে চলে যায়।
সিঁদুরের মতো গুঁড়ো, গেরুয়ার ঈষৎ আভাস!—
আকাশ প্রচ্ছদপট জীবনের এইসব রঙিন বিকাশ
দেখে দেখে আজও আমি হালখাতা খুলে বসি আবার আশায়
যেন ফের এ বছর উড়ে যেতে পারি সেই দেশে
যেখানে নদীর জলে পালা-পট-পুরাণকথারা এসে
হিরন্ময় ঢেউ হয়ে যায়।
বেজে ওঠে জীবনের করতালি, নতুন বধূর মতো
আজও এই দিবসের মুখ
আমাদের প্রিয়তর হয়ে ওঠে—সাড়া জাগে—পহেলা বৈশাখে
আবার সৃজনবোধে মানুষেরা জেগে ওঠে—
ইতিহাসদগ্ধ দেহে হলুদ নবনী তারা পুনরায় মাখে \
ঢাকা, ৯ এপ্রিল ২০১২
No comments:
Post a Comment