ইসলামে মানবসেবা ও মানবপ্রেম
মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানী
ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনায় ইসলাম দিয়েছে যুগপৎ ঘোষণা। এ ক্ষেত্রে ইসলামের দ্বার সর্বদাই উন্মোচিত। সত্যি বলতে কি, এ বিষয়ে ইসলাম যে পদক্ষেপ ও পদ্ধতি বাতলে দিয়েছে, তা বিশ্বে আজও চিরভাস্বর হয়ে আছে। যদি সেদিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখতে পাব ইসলাম কী বলে? মুসলিম শরিফের এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'মুসলিম জাতি এক ব্যক্তির ন্যায়। এক দেহের কোনো অঙ্গ ব্যথিত হলে সারা শরীর বা অঙ্গই সে ব্যথা উপলব্ধি করতে পারে। তেমনি এক চোখে ব্যথা হলে সারা শরীরেই সে ব্যথার একটা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এমনিভাবে মাথায় ব্যথা হলে সারা দেহেই সে ব্যথার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে যায়।'
আলোচ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব মুসলমানকে এক কাতারে শামিল করে এক দেহ বা এক শরীর বলেছেন। বোঝা গেল, সবাই এক দেহ, এক শরীর ও এক মন, কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সবাই একই গোষ্ঠী এবং শ্রেণীভুক্ত। আরো বোঝা গেল, আমার একটি অঙ্গ ব্যথিত হলে গোটা শরীরেই সেই ব্যথা অনুভব করি। তদ্রূপ কোনো মুসলমান ভাইবোন যদি ব্যথিত বা অসুস্থ হয়, সে ক্ষেত্রেও মনে করতে হবে আমারই কোনো অঙ্গ অসুস্থ হয়েছে, ব্যথিত হয়েছে।
আমি নিজকে যতটুকু ভালোবাসি। নিজ দেহের যেমন যত্ন নিই, পরিচর্যা করি, অবহেলা করি না- তেমনি অন্যের প্রতিও অবহেলা দেখানো যাবে না। মানুষের প্রতি দয়াশীল হতে হবে, মন উজাড় করে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। পরিপূর্ণ সহানুভূতি আর সুহৃদ্যতার দ্বারা মানবসেবায় এগিয়ে আসতে হবে। সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে পরের ওপর দয়ার্দ্র হতে হবে। এ ব্যাপারে অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে- 'তোমরা দুনিয়াবাসীর প্রতি দয়া করো, তাহলে আসমানবাসী তথা মহান আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।' (তিরমিজি শরিফ)
মানুষ মানুষের জন্য। এক মানুষ অপর মানুষের দয়া-সহানুভূতি ছাড়া চলতে পারে না। মানুষ যদি চায় যে সে অপরের কাছ থেকে ভালোবাসা ও দয়া পাবে, তাহলে তাকেও অকৃত্রিমভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষকে ভালোবাসলে আল্লাহ খুশি হন। মানুষের ভালোবাসা ছাড়া, মানবসেবা ছাড়া আল্লাহর ভালোবাসা ও তাঁর দয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। ওপরে বর্ণিত হাদিস এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবতার আদর্শ শিক্ষা দানকল্পে অপর এক হাদিসে ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের থেকে একমাত্র দয়ালু বান্দাদের প্রতিই দয়া করে থাকেন। (বুখারি শরিফ)।
মানুষের সেবা করলে আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করবেন। বিপদগ্রস্ত অসহায় অভাবী দরিদ্র অনাথের সেবায় এগিয়ে এলে, তাদের ব্যথায় ব্যথিত হলে, দুঃখে দুঃখিত হলে আল্লাহ তায়ালাও আমাদের প্রতি দয়া করবেন, আমাদের বিপদ দূর করে দেবেন এবং অভাব মোচন করে দেবেন। আর যদি আমরা মানুষের কল্যাণকামিতার পরিবর্তে মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টায় সচেষ্ট থাকি, কিভাবে অপরকে আটকানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকি, তাহলে আল্লাহ তায়ালাও আমাদের আটকে দেবেন। মানবপ্রেমের দুয়ার সবার জন্যই খোলা রাখতে হবে, আপন-পর সবাই এ ক্ষেত্রে সমান। মানবতার সেবা সবার জন্য সমান রেখে সমাজের সর্বশ্রেণীর লোককে এক কাতারে শামিল করতে হবে। এমনকি যারা বেশি অভাবী এবং দূরের আত্মীয় বা প্রতিবেশী তাদের অধিকার বেশি রাখতে হবে। বিশেষভাবে সমাজের এতিম মিসকিন, একেবারে অসহায় যারা, যাদের ভরণপোষণের দায়ভার নেওয়ার তেমন কেউ নেই। এ ধরনের মানুষের পাশে সব সময় থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন 'আমি এবং এতিমের তত্ত্বাবধানকারী এ দুজন বেহেশতের এ রকম পাশাপাশি থাকব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর শাহাদাত আঙুল এবং বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা ইশারা করে দেখালেন, এ হাদিসে এতিমের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনকারী বা তত্ত্বাবধানকারীর প্রতি কত সৌভাগ্যের কথা এসেছে যে সে ব্যক্তি আল্লাহর পেয়ারা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে পাশাপাশি বেহেশতে থাকবে। অনেক অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার, আমাদের সমাজের কয়জন এমন আছি, যারা অসহায় এতিমের খোঁজখবর নিই, খুবই নগণ্যসংখ্যক হবে। এমনিভাবে এতিমের প্রতি মমত্ববোধ প্রদর্শন করার ব্যাপারে অপর হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন 'যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায় কোনো এতিমের মাথায় হাত বুলাবে, যেসব চুলের ওপর দিয়ে তার হাত অতিক্রম করবে, তার প্রতিটি চুলের বিনিময়ে ওই ব্যক্তির জন্য নেকি লেখা হবে।
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতিমের খোঁজখবর নেওয়ার ব্যাপারে এমন মানবতাবাদী ছিলেন যে নিজে স্বয়ং এতিমের তত্ত্বাবধান করতেন এবং বলতেন, 'কেউ যদি এমন এতিম সন্তান রেখে যায়, যার কোনো প্রতিপালনকারী এ দুনিয়ায় না থাকে, তাহলে এমন এতিমের দায়দায়িত্ব আমি নিয়ে নিলাম। এমনিভাবে সমাজের সব এতিমের দায়িত্ব আমার।' (ইবনে মাজা)। আমাদের সমাজে অনেক নিঃস্ব অসহায়, স্বামীহারা বা বিধবা নারী রয়েছেন কিংবা তালাকপ্রাপ্ত নারী রয়েছেন, যাঁরা খুবই অসহায়। এ ধরনের মহিলার ব্যাপারেও রাসুল (সা.) বিশেষভাবে খোঁজখবর নেওয়ার কথা হাদিসে এসেছে। এ সম্পর্কে আল্লাহর হাবিব (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি বিধবা ও মিসকিনদের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করবে, সে হচ্ছে ওই ব্যক্তির মতো, যে আল্লাহর পথে জিহাদে রত কিংবা ওই ব্যক্তির মতো যে সারা রাত নফল নামাজ পড়ে আর সারা দিন নফল রোজা রাখে।' আলোচ্য হাদিসে বিধবা নারীর প্রতি সহমর্মিতাকারীর ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের সমাজে আজ বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত অথবা বৃদ্ধ নারীরা কত নির্যাতনের শিকার। তাদের নিয়ে কতই না অবহেলা আমরা করে থাকি। না খেয়ে, না পরে মারা গেলেও আমরা তাঁদের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখাই না। আমরা আবার মানবতাবাদী বলে দাবি করি।
সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষ যদি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আদর্শ বাস্তব জীবনে অনুসরণ করে, তাহলে পুরো সমাজের চিত্রটাই পাল্টে যাবে। কেননা রাসুল (সা.) যে আদর্শ রেখে গেছেন তাঁর একটি নমুনা পেশ করছি-
হিজরত করে মহানবী (সা.) যখন মাতৃভূমি ছেড়ে মদিনায় আসেন, অনেক সাহাবিই মক্কায় নিজ বাড়িঘর, অর্থকড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ছেড়ে মদিনায় চলে আসেন। তাঁরা হলেন মুহাজির। তাঁরা এত অসহায় ছিলেন যে মক্কা থেকে একটু দানাপানিও আনতে পারেননি। আহ্, কী করুণই না ছিল তাঁদের সে সময়ের অবস্থা! এর পর মুহূর্তে আল্লাহর রাসুল (সা.) সব আনসার সাহাবিকে ডেকে বললেন, 'তোমাদের সচ্ছলরা এবং সামর্থ্যবানরা যে যা পারো তোমরা প্রত্যেকে একেকজন মুহাজিরের দায়িত্ব গ্রহণ করে নাও। যে কথা, সেই কাজ। পর্যায়ক্রমে ৪৫ জন আনসারি সাহাবি ৪৫ জন মুহাজিরের দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। এবং আনসারি সাহাবিদের মানবতাবাদী সহমর্মিতার ফলে মুহাজিররা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেন। বাহ্ কী দারুণ? আল্লাহর মানবতাবাদী রাসুল (সা.) কিভাবে একটি সামাজিক সমস্যার সমাধান দিলেন।
এমনিভাবে আরেকটি পদ্ধতিতে আমাদের সামাজিক অবকাঠামোর রূপই ঘুরিয়ে দিতে পারি। তাহলে আমাদের শহরবাসী একজন যদি গ্রামের অসহায় দুই একজনের দায়িত্ব নিয়ে নিই, তাহলে আমাদের সমাজের অসহায়ত্ব অনেকাংশেই হ্রাস পাবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যেই নিহিত আছে মানবতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সে পথে চালনা করুন, যে পথে আছে মানবতার কল্যাণ। আমীন।
লেখক : খতিব , মিজমিজি বাতানপাড়া কবরস্থান মসজিদ, সিদ্ধিরগঞ্জ
http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=13-04-2012&type=main&cat_id=1&menu_id=92
No comments:
Post a Comment