Monday, April 16, 2012
চারুকলার আয়োজন
চারুকলার আয়োজন
আফসানা আশা
শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আসছে পহেলা বৈশাখ। আসছে বর্ষ বরণের দিন। নিখাদ বাঙালিয়ানা যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় সেটা হলো বর্ষবরণ বা পহেলা বৈশাখের দিন। বাংলার জল-মাটি-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা যেসব সংস্কৃতি, তার অনেকটাই উঠে আসে পহেলা বৈশাখে। পহেলা বৈশাখ মানে নিজেদের বাঙালিয়ানাকে নতুন ভাবে, নতুন রূপে, নতুন রঙে উপস্থাপন করা। তাই বাঙালি যে যেখানে থাকুক না কেন, পহেলা বৈশাখে মাতোয়ারা হতে ভোলে না। পান্তা-ইলিশ আর মণ্ডা-মিঠাইয়ের সুঘ্রাণ তাদের ঠিকই মোহিত করে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। আমি আমার শৈশব-কৈশোরের সময় পার করেছি মফস্বলে। পহেলা বৈশাখ যখন বুঝতে শিখেছি, তখন আমার কাছে পহেলা বৈশাখ মানেই ছিল মেলার আর বেশি দিন বাকি নেই। পহেলা বৈশাখে আমাদের গ্রামের বড় মাঠটায় তিন দিনের মেলা হতো। আমি উন্মুখ হয়ে থাকতাম সে মেলার জন্য। মেলা এলেই পুতুল, মাটির খেলনা, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, চুড়ি, খাবার ইত্যাদি কেনা হতো। আর আমার পুতুলের সংসারে নতুন পুতুল ও নতুন খেলনা যোগ হতো; এতেই আমার আনন্দ। এটাই আমার শৈশবের পহেলা বৈশাখ। পুতুল খেলার দিন পার করার পর যখন স্কুলজীবন শুরু করলাম তখন পহেলা বৈশাখ মানে ছিল ছুটির দিন। ছুটির দিনে মা-ভাইদের সঙ্গে মামার বাড়ি যাব_এতেই আনন্দ। আমি তখন শরৎ বুঝি না, বসন্ত বুঝি না_আমি বৈশাখ বুঝি। মামাবাড়ি যাওয়ার বৈশাখ। যখন স্কুলজীবনের অনেকটা পার করে ফেলেছি তখন পহেলা বৈশাখ এলো নতুনভাবে। নতুন রূপ দেখলাম পহেলা বৈশাখ। এটি বাংলা বছরের বাংলা মাসের প্রথম দিন। বাঙালিদের উৎসবের দিন, আনন্দের দিন। চারদিকে যেন আনন্দ থৈ থৈ করে এই দিনে। স্কুল-কলেজে দিনব্যাপী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। গ্রামের পাশেই বড় মেলা। পহেলা বৈশাখের দিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে হৈ হৈ করে পান্তা-ইলিশ খাওয়া যেন অমৃত সমান। সেদিন সবাই নতুন পোশাক পরে। মাকেও দেখতাম নতুন শাড়ি পরতে। আমরা বন্ধুরাও মায়ের কাছ থেকে শাড়ি পরে নিতাম। তারপর দল বেঁধে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়া, রং মাখামাখি করা, ধুলো ভরা পথে হেঁটে বেড়ানো, ঘাম-গরম উপেক্ষা করে মেলায় যাওয়া, পছন্দের জিনিস কেনা_সব কিছুই হতো। সেদিন সবার বাড়িতেই নানা রকম খাবারের আয়োজন থাকত। বন্ধুরা পালা করে বন্ধুদের বাড়ি খেতে যেতাম। সারা দিন কিভাবে চোখের পলকে কেটে যেত, বুঝতেই পারতাম না। দিন শেষে মনে হতো প্রতিটি দিনই পহেলা বৈশাখ হয় না কেন? পহেলা বৈশাখের আরেকটা ব্যাপার ভালো লাগত; সেটা হলো হালখাতা। পহেলা বৈশাখের দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত দোকানে দোকানে হালখাতা উৎসব। নানার সঙ্গে আমরা ভাইবোনরা যেতাম হালখাতা খেতে। সেটাও কম মজার ছিল না। এখন আমি ঢাকায় থাকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। পহেলা বৈশাখ যে বাঙালি সংস্কৃতির কতখানি জুড়ে আছে, তা এখানে এসে নতুনভাবে জানলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের অনেকটাই করে বাংলা ও চারুকলা অনুষদ। পহেলা বৈশাখ আসার আগে থেকেই কাজ শুরু হয়ে যায়। নানা ধরনের মুখোশ, ছবি, কারুকাজ করা সানকি, সরা, খেলনা আগে থেকেই স্টল করে বিক্রি শুরু হয়। এগুলো বিক্রির টাকা দিয়েই চলে বৈশাখের কাজ। সারা দিন ধরে, রাত জেগে ছেলেমেয়েরা বৈশাখের কাজ করছে দেখলেই অন্য রকম অনুভূতি জাগে। পহেলা বৈশাখের আগের দিন চারুকলায় চৈত্রসংক্রান্তি পালন আরেক বিস্ময়। আর পহেলা বৈশাখের দিন তো কথাই নেই_মঙ্গল শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু। সেদিন আর ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ-অসাধারণ, উঁচু-নীচু কোনো স্তরই থাকে না। নানা জায়গা থেকে নানাজন এসে যোগ দেয় সেই শোভাযাত্রায়। ছেলেমেয়েরা প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ফেস কার্টুন, মুখোশ সব কিছু নিয়ে হাজির হয় শোভাযাত্রায়। পান্তা-ইলিশ, রং মাখামাখি, বাউল উৎসব, যাত্রাপালা, লোকজ গানের উৎসব_সব কিছুই যেন মুখরিত করে রাখে চারদিক। সবার চোখে-মুখে সেদিন যে আনন্দের ছবি ভেসে ওঠে তা সবাই বুঝে নিতে পারে। এত আনন্দ, এত সুখ, এত বিস্ময় যে বাঙালিয়ানায় লুকিয়ে আছে, তা সবাই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে সেদিন।
http://www.kalerkantho.com/?view=details&archiev=yesdate=14-04-2012&type=main&cat_id=1&menu_id=180
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment