Monday, April 16, 2012

নববর্ষ ১৪১৯



নববর্ষ ১৪১৯
বৈশাখ মাসে যেমন চাষের জমিনে নতুন পানি আসে, আর সেই পানিতে নতুন স্বপ্ন নিয়ে চাষি বীজ বোনে, তেমনি তরুণরাও 'চন্দ্রটারে বল বানিয়ে' খেলতে চায় পৃথিবীর মাঠে। এমনই স্বপ্নপ্রণয়ী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থীর লেখা 'আমাদের পহেলা বৈশাখ' নিয়ে আজকের আয়োজন


স্বপ্নের বিকিকিনি, সেই সব উৎসব
নিশাত নওশিন
শিক্ষার্থী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


"বৈশাখের ওই মাঠের কাছে এলো নদীর জল
চন্দ্রটারে বল বানিয়ে ছুটছে ছেলের দল
জ্যৈষ্ঠে এবার পাখি হবো যে যা বলিস ভাই
তোমার বাড়ির আমের ডালে ঝুইলা থাকতে চাই"
বৈশাখের চাষের জমিতে নতুন জল আসে, স্বপ্নের বিকিকিনি করে সেই জলে ছেলেমেয়েরা। ঠিক নতুন জলের মতো বৈশাখের প্রথম দিনটি আমরা বরণ করি আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের মাধ্যমে। আমার মনে হয়, পহেলা বৈশাখ যদি আমরা আনন্দ-উৎসবের মধ্যে বরণ না করি তাহলে নতুন বছর আমাদের সঙ্গে অভিমান করে থেমে থাকবে, শুরু হবে না। বৈশাখ নিয়ে থাকে আমাদের অনেক পরিকল্পনা, ভাবনা, শাড়ি, পাঞ্জাবি পরা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া, আনন্দ শোভাযাত্রায় যাওয়া_সব কিছু ভুলে যাওয়া, শুধু হৃদয় দিয়ে আনন্দটুকু অনুভব করা ইত্যাদি।
আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে। তখনকার বৈশাখের সঙ্গে বর্তমানের অনেক পার্থক্য। তবু এ দুইয়ের মধ্যে মৌলিক যোগসূত্র বা মিল হচ্ছে আনন্দ বা মজা করা, নিজেকে আপন সংস্কৃতির মধ্যে মেলে ধরা। চৈত্রের প্রখর তাপ যখন প্রকৃতিকে পুড়িয়ে ফেলতে চাইত, মানুষ ছটফট করত সেই তাপের তীব্রতায়, তখন বৈশাখের আগমন হতো আশীর্বাদস্বরূপ। বৈশাখ তার কোমল স্পর্শে প্রকৃতিকে যেন জীবন্ত করে তুলত। পহেলা বৈশাখে আমাদের গ্রামে মানিকগঞ্জে বসত অনেক বড় মেলা। এ মেলা একদিকে যেমন সবার আনন্দের কারণ ছিল, তেমনি পূরণ করত অতিপ্রয়োজনীয় চাহিদা। বৈশাখী মেলাকে ঘিরেই আমার আনন্দ আবর্তিত হতো। মেলার আগের রাতে হঠাৎ জেগে উঠতাম সকাল হওয়ার অপেক্ষায়। খুব সকালে উঠে মেলায় যাওয়ার বায়না ধরতাম। নতুন জামা পরে সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে মেলায় যাওয়া। মেলায় ঢোকার পথে থাকত বিভিন্ন খাবারের দোকান। কচি তালের শাঁস আমার অনেক ভালো লাগত। একটু ভেতরে ছিল কুমারের দোকানের সারি, সেখানে থরে থরে সাজানো মাটির হাঁড়ি, কলস, ফুলের টব, ব্যাংক এবং বিভিন্ন রকম মাটির তৈরি খেলনা। দেখতে খুব সুন্দর লাগত। বৈশাখে সবার ঘরে নতুন ধানের পিঠা, চিঁড়া ও মুড়ি ভাজার জন্য মানুষ এই কুমারের দোকানে এসে ভিড় জমাত। কারণ পিঠার সাজ, চিঁড়া ও মুড়ি ভাজার মাটির ঝাঁঝর-সাবনা এখানেই পাওয়া যেত। আমি মাটির ব্যাংক কিনতাম টাকা জমানোর জন্য, তা ছাড়া মাটির ছোট ছোট খেলনা হাঁড়ি-পাতিলও কিনতাম অনেক আনন্দ নিয়ে। এরপর বাঁশ ও বেতের দোকানে পাওয়া যেত কুলা, ঝুড়ি ও শৌখিন অনেক জিনিস। মেলার অনেকাংশজুড়ে থাকত বেদের দোকান। সেখান থেকে দুই হাত ভরে রেশমি চুরি কিনতে খুব ভালো লাগত। এ ছাড়া প্রসাধনসামগ্রী পাওয়া যেত সেখানে। মেলায় বিভিন্ন মৌসুমি ফল যেমন_আম, জাম, কাঁঠাল, তরমুজ, বাঙ্গি, লিচু স্থান পেত। হরেক রকম কাঠের আসবাব সাজানো থাকত। মেলায় সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত নাগরদোলায় চড়া ও পুতুল নাচ দেখা। এ ছাড়া রং-বেরঙের ঘুড়ি পাওয়া যেত; যার সুন্দর সুন্দর নামও আছে। যেমন_পতেঙ্গা, চিলা, কয়রা, সাপা ইত্যাদি। পুরো মেলা ঘুরে পছন্দমতো জিনিস কিনে দিনশেষে বাড়ি ফিরতাম, তখন সূর্যের লাল আভা প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দিত অপরূপ মন হারানোর উজ্জ্বলতায়। বৈশাখের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য ব্যাপার ছিল যাত্রাপালা, পালাগান, কবিগান, জারিগান ইত্যাদি। বিভিন্ন এলাকার জনপ্রিয় সব বয়াতি এসে গান পরিবেশন করতেন। পালাগানের মধ্যে ছিল ধর্মবিষয়ক শরিয়ত-মারফত পালা, গুরু-শিষ্যের পালা ইত্যাদি। যাত্রাপালাগুলো হচ্ছে কাজলরেখা, মধুমালা-প্রেমকুমার, কমলার বনবাস, ভাষান যাত্রা, ইমান যাত্রা, গুনাই বিবি, মহুয়া সুন্দরী, কাশেম মালা ইত্যাদি।
গ্রামের মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে থাকত কবে বৈশাখ মাসের এসব উৎসব অনুষ্ঠান হবে। তারা সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে রাতের বেলায় এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করে সব ক্লান্তি ভুলে যেত। এখন এসব জনপদে শ্বাপদের হুংকার, হারিয়ে যাচ্ছে যাত্রা, কবিগান।
সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তন এসেছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। আজ আমার বৈশাখ নিয়ে ভাবনারও পরিবর্তন হয়েছে। আমরা এতটাই অনুকরণপ্রিয় যে বিদেশের প্রভাবে বা অনুকরণে নিজেদের স্বতন্ত্র ঐতিহ্যটুকু হারাতে বসেছি। তাই পহেলা বৈশাখে উৎসব-আনন্দের মাঝে আমাদের নিজেদের খোঁজার প্রবণতা থাকে। যদিও ফরমায়েশি পান্তা-ইলিশ প্রতীকায়িত সামন্ত সমাজবাস্তবতার ফসল মনে হয় নাগরিক জীবনে। তবু এটাকে উৎসব হিসেবে মনে-প্রাণে সেসব আনন্দময় দিনে ফিরে যেতে চেষ্টা করছি আমরা।


হাটের সেই সব হালখাতা
হালিমা খুশি
শিক্ষার্থী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


কচি কচি সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে চারদিক। চৈত্রের দাবদাহ, সঙ্গে দমকা হাওয়া_এসবই যেন জানিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিতে বৈশাখের আগমন ধ্বনি। বৈশাখকে স্বাগত জানাতে বাঙালি জাতি হয়ে আছে উন্মুখ। প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালিও যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নানা আয়োজনে। উৎসবমুখর এ আয়োজনে মাঝেমধ্যেই যেন হারিয়ে যাই ছোটবেলার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের দিনগুলোর কথা মনে করে। ছোটবেলার সেই বৈশাখ মানে নতুন জামা, নতুন জুতা পরে পুরো গ্রাম চষে বেড়ানো।
বৈশাখের আগের দিনে দেখতাম, মায়ের ঘরদোর ঝাড়া মোছা পরিষ্কার করার ধুম। মা যেন চৈত্রের সংক্রান্তিতে সব দুঃখ-কষ্ট হটিয়ে দিতেন, যাতে নতুন বছর আসতে পারে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে। মায়ের এই কর্মব্যস্ততা দেখে আমার ঈদ-ঈদ মনে হতো। বাবার এনে দেওয়া ফ্রকটি বারবার বের করে দেখতাম আর ঘুমানোর সময় মাথার কাছে নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। অপেক্ষা করতাম, কখন সকাল হবে, কখন নতুন জামা, জুতা পরে ঘুরব সারাটা দিন। এসব ভাবনাকে সঙ্গী করে একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম।
প্রতীক্ষার প্রহর শেষে যখন প্রতীক্ষিত সেই সকালটি আসত, তখন কী যে ভালো লাগত! ছোটবেলায় গ্রামে পান্তা-ইলিশ ব্যাপারটির সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিলাম না। তাই তো গরম ভাত আর মায়ের হাতের সুস্বাদু মাংস খেয়ে নতুন কাপড় পরে সারাটা দিন টই টই করে ঘুরে বেড়াতাম। সেদিন যেন মুক্তবিহঙ্গ আমি। পড়ন্ত বিকেলে বাবার সাইকেলের ক্যারিয়ারে চেপে হাটে যেতাম হালখাতা খাওয়ার জন্য। খুব আগ্রহ নিয়ে, খুব মজা করে জিলিপি, বুন্দিয়া, নিমকি খেতাম। ছোটবেলায় এ খাবারগুলো অমৃত মনে হতো। খাবার শেষে আমার কোনো চাচার সঙ্গে বাবা আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। আর এভাবেই কেটে যেত ছোটবেলার গোছানো জগৎটার বৈশাখী দিন। এই দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই আজ কোথায় যেন হারিয়ে যাই।
সেই ছোট আমিটি তো আর ছোট নেই। আজ আমি বড় হয়েছি। তাই তো আমার বৈশাখ বরণে এসেছে ভিন্নতা। মা-বাবা, বাবার সেই সাইকেল আজ আর আমার বৈশাখের সঙ্গী নয়; সঙ্গী হয়েছে আমার ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাসের বন্ধুবান্ধব। এখন বৈশাখে লাল-সাদা বৈশাখী রঙে নিজেকে রাঙিয়ে, খোঁপায় লাল ফুল গুঁজে ডিপার্টমেন্টের শোভাযাত্রায় বের হই; হাতে থাকে বাঁশের বাঁশি, ফেস্টুন। তবে আমাদের শোভাযাত্রার সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য গ্রামীণ চরিত্র উপস্থাপন করা হয়। গ্রামীণ এ চরিত্রগুলোর মধ্যে থাকে গ্রাম্য মোড়ল, জেলে, লাঠিয়াল, গ্রাম্যবধূ, পুরোহিত, সাপুড়ে। শোভাযাত্রা শেষে সবার মধ্যে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। খাওয়া শেষে আমরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করি।
এই একটা দিন যেন আমরা আমাদের গ্রামবাংলার শেকড়ের কাছে চলে আসি। এই একটি দিন ঘিরে বাঙালির এত আয়োজন। তাই তো এই আয়োজনে আমরা প্রার্থনা করি, সমস্বরে গেয়ে উঠি_'মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা অগি্নস্নানে শুচি হোক ধরা।'

http://www.kalerkantho.com/?view=details&archiev=yesdate=14-04-2012&type=main&cat_id=1&menu_id=180

No comments:

EID MUBARAK to everybody