Monday, April 16, 2012

ছোট্ট বাবুর বৈশাখে আবৃত্তি


ছোট্ট বাবুর বৈশাখে আবৃত্তি
হাসান মারুফ
শিক্ষার্থী
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

মানুষের জীবনে বিশেষ ঘটনার মুহূর্তগুলো ছাড়া যে কয়টি স্মৃতি মনের কুঠরিতে আবদ্ধ থাকে, তা হলো উৎসবের। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের মিলনমেলা। এর সঙ্গে আর সবার মতো আমার প্রাণের যোগাযোগও অত্যন্ত গভীর।
বর্তমানে নববর্ষের দিনগুলোতে অনেক স্বাধীনতা পাই। ঘুরতে যাওয়া, আড্ডা, ফুর্তি_সব কিছুই এখন কিছুটা রঙিন। তবে শৈশবে দিনগুলো এ রকম ছিল না।
আপাতদৃষ্টিতে উদার মনে হলেও ভেতরে কট্টর স্বার্থপর রক্ষণশীল পরিবারে আমার বাস। জীবনের বহু কিছু তাই অপ্রাপ্য রয়েছে। কোনোটি পূরণযোগ্য, বেশিরভাগই অপূরণীয়। ২৫ বৈশাখ, ১১ জ্যৈষ্ঠ পালন তো অসম্ভব; কিন্তু পহেলা বৈশাখের যে চরম আহ্বান, তার ডাক এখানেও পড়ত। স্বাভাবিকভাবেই এই দিনের জন্য বিশেষ প্রতীক্ষায় থাকতাম।
আমার মায়ের রান্নার হাত খুব ভালো। বর্তমানে অসুস্থ বলে সে দুটি হাত আগের মতো কাজ করে না। কিন্তু যখন করত, তখনকার কথাই ছিল আলাদা। সকালে ঘুম ভাঙত পান্তা ভাত আর ইলিশের ঝাঁঝালো গন্ধে। এর জন্য তোড়জোড় অবশ্য শুরু হতো বহু আগে থেকেই। বাবা চার-পাঁচ দিন আগেই ডজনের কাছাকাছি ইলিশ মাছ কিনে আনতেন। কাটাকুটি শেষে ফ্রিজে সেগুলো প্যাকেট করে তুলে রাখা হতো। বের করা হতো একেবারে রান্নায় দরকারমতো। কাটার সময় একটু পর পরই রান্নাঘরে ছুটে যেতাম। মাছের টুকরোগুলো যাতে বড় হয়, সে জন্য আবদার সব সময়ই চলত। খাওয়ার জন্য আমার বেশ নাম আছে। তবে বর্তমান যুগ বিচারে সেটা গর্ব করার মতো কিছু নয়।
মাছগুলো একেবারে কড়া করে ভেজে যখন তোলা হতো, তখন মন খুশিতে চনমন করতে থাকত। একটু পরই প্লেটে আসবে। মনের ভেতর উত্তেজনা। বিশ্বকাপ ফাইনালের মতোই মজার; কিন্তু নিশ্চয়তা আছে, এই যা।
তবে নববর্ষের ক্ষেত্রে ঘরে যেটা বিশেষভাবে সব সময়ই হতো, তা হলো ভর্তা। এই একটা জিনিস যে কত প্রকারের হতে পারে, তার একটা ছোটখাটো নমুনা পহেলা বৈশাখের দিন দেখতে পেতাম, এখনো পাই। চিংড়ির ভর্তা, তাও মাথা, শরীর, বিশেষ মরিচে_তিন ভাগে। এরপর আছে বিভিন্ন সবজির ছাল (ভদ্র ভাষার লোকেরা খোসাও বলতে পারেন) মুড়ে ঝাল পরিবেশন, আলু, কাঁচকি মাছসহ আরো বহু বহু ভাগ, যাকে বলে একেবারে হুলুস্থূল দৃশ্য। পেঁয়াজ, মরিচ, মাছসহ যখন টেবিলে সেগুলো দেওয়া হতো, বাঘের বাচ্চার মতো হামলে পড়তে দেরি কখনোই হয়নি। সমস্যা হলো, নববর্ষের আনন্দ এতটুকু হলে চলে না, মানায়ও না। একটা জব্বর খানা দিলাম। এরপর ছুটির দিন ফ্যান ছেড়ে নাক ডাকতে ডাকতে সময় অতিবাহন। যা-ই হোক, এত ছোট স্মৃতি ভালো কিছু নয়। তবে অভিজ্ঞতা ক্লাস ফোর-ফাইভ থেকে বাড়তে লাগল।
ছোটবেলা থেকে একটা জিনিস আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো ছিল, তা হলো বিভিন্ন ক্লাব আর তাদের কর্মকাণ্ড। প্রধানত ডিবেট করাটা ছিল মূল; সঙ্গে কুইজ, আবৃত্তিসহ আরো বহু কিছু ছিল নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক সংঘ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমার কাজ ছিল নজরুলের 'প্রলয়োল্লাস' পাঠ। ছোটবেলায় গলা খুব মিষ্টি ছিল। সম্ভবত মিথ্যাচার হয়ে যায়। সোজা বাংলায় মেয়েমানুষের মতো। মর্দামি ভাবটা অনুপস্থিত। তার ওপর এত বড় ঝাঁঝের কবিতা। বয়সও কম। কী মনে করে যে আমাকে ওটা দেওয়া হয়েছিল, ক্লাবকর্তারাই জানেন। পুরো কবিতা পড়ে দেখি, কিছুই বুঝিনি। মাথার ওপর দিয়ে যেন ১৫০০ ক্যালিবারের গুলি। এটুকু জানি, নজরুল বিদ্রোহী। আর কী লাগে_বাবরি চুল, পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা, গায়ে চাদর জড়ানো। ওটা নিয়ে একেবারে কামানের গায়ে বসে পোজ দিচ্ছেন (পরে জেনেছি, সেটার নাম দলমাদল, খুব বিখ্যাত)। দেখলেই কেমন সিংহ সিংহ লাগে। ছোটবেলা থেকেই বিবাগী, পরে খাকি পরে পল্টনে গিয়ে জবরদস্ত পিটাপিটি করেছেন (অবশ্য পরে এও জেনেছি, সে সুযোগ তাঁর হয়নি)। জেলখাটা, 'কারার ঐ লৌহকপাট'-এর লেখক। তাই কবিতা না বুঝলেও চলবে। কাজ হলো, যত জোরে পারা যায় গলার পর্দা চড়িয়ে মঞ্চে ভূমিকম্প তৈরি করতে হবে। সেদিন মোটামুটি যে হারে চেঁচিয়েছিলাম, শব্দদূষণে জেল-জরিমানা হলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকত না। মজার ব্যাপার ঘটল যখন অনুষ্ঠান শেষ, দেখলাম প্রচুর হাততালি। এত 'কুট্টিবাবু'র এত কঠিন গলাবাজি (দলমাদল কামানও সম্ভবত ওর চেয়ে কম আওয়াজ করত) শুনে সবাই খুব খুশি হয়েছিল। আসল ঘটনা ঘটল যখন রবীন্দ্রসংগীত শুরু হলো, ঠিক তখন। জীবনে প্রথম সুরসুধা সেদিনই বুঝেছি। 'এসো হে বৈশাখ' থেকেই হয়তো বা লেখক হওয়ার ডাক পেয়েছিলাম। পরে নজরুল, আধুনিক সব সংগীতই হলো। বাংলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে আতলামি করলেন। আতলামি বলাই ভালো, কারণ যে আবেগ নিজের ভাষায় হয় না, সেটাকে অন্যের ভাষায় ভাব করে বলতে গেলে ওই দশাই দাঁড়ায়। কিন্তু এরপর স্বপ্ন দাঁড়াল গান গাইতে হবে; না পারলে শুনব অবশ্যই।
রমনার হামলা শেষে মন চাইলেও যাওয়া কঠিন ছিল। বাসায় আপত্তি, অবশেষে ক্লাস এইটে থাকতে প্রথম একলা কাউকে না বলে গেলাম। বিশাল মঞ্চে সবাই যখন গান গাওয়া শুরু করল, রক্তে স্পন্দন বাজতে থাকে। শৈশবের এমন অনেক মজার স্মৃতি আছে বৈশাখ নিয়ে, অন্য একদিন বলা যাবে সেসব।

http://www.kalerkantho.com/?view=details&archiev=yesdate=14-04-2012&type=main&cat_id=1&menu_id=180

No comments:

EID MUBARAK to everybody