Sunday, April 15, 2012

ইমাম আল-গাজ্জালি ও তাঁর চিন্তাধারা

ইমাম আল-গাজ্জালি ও তাঁর চিন্তাধারা মাহমুদ আহমদ সুমন
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য এবং পৃথিবীর বুক থেকে সব অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্যায়, অসত্য, শোষণ, জুলুম, অবিচার, ব্যভিচার, শিরক, কুফর, কুসংস্কার এবং মানব রচিত মতবাদ ও মতাদর্শের মূলোৎপাটন করে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক জাতিতে যুগে যুগে লক্ষাধিক নবী-রাসুলকে খোদাতায়ালা পাঠিয়েছেন। হজরত রাসুল করিম (সা.) ও তাঁর চার খলিফার মৃত্যুর পর পথহারা মানুষের সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য প্রতি যুগেই ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ এক বা একাধিক আউলিয়ায়ে কেরাম ও ধর্ম সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটেছে। এসব আউলিয়ায়ে কেরাম ও ধর্ম সংস্কারকরা নতুন কোনো মত বা মতাদর্শ প্রচার করেননি। তাঁরা সবাই বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশিত পথে এবং তাঁরই আদর্শের দিকে আহ্বান করেছেন। আউলিয়ায়ে কেরাম ও ধর্ম সংস্কারকদের চরিত্র, স্বভাব ও সাধারণ জীবনযাত্রা দেখে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ফিরে আসবে সত্য-ন্যায়ের পথে। হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.) ছিলেন তাঁদেরই একজন।
ষষ্ঠ হিজরি শতাব্দীতে মানুষ অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুফর, শিরক, বিদআত, কুসংস্কার ও নানাবিধ পাপকাজে লিপ্ত হতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে শিক্ষিত যুবসমাজ পাশ্চাত্যের অমুসলিম দার্শনিকদের ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে ইসলামের সত্য পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল, তখন পৃথিবীতে সত্যের আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হন হজরত ইমাম আবু হামেদ গাজ্জালি (রহ.)। তিনি ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল এ ইরানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ সাদী (রহ.), মহাকবি ফেরদৌসি (রহ.), আল্লামা হাফিজ (রহ.), আল্লামা রুমি (রহ.) এদের মতো মুসলিম মনীষীরা। ইমাম গাজ্জালি (রহ.)-এর প্রকৃত নাম আবু হামেদ মোহাম্মদ গাজ্জালি। কিন্তু তিনি ইমাম গাজ্জাল নামেই খ্যাত। গজ্জাল শব্দের অর্থ হচ্ছে সুতা কাটা। এটা তাঁর বংশগত উপাধি। কারো মতে, তাঁর পিতা মোহাম্মাদ কিংবা পূর্বপুরুষরা সম্ভবত সুতার ব্যবসা করতেন। তাই তাঁর উপাধি হয়েছে গাজ্জালি।
তাঁর পিতা ছিলেন দরিদ্র এবং শৈশবেই তিনি তাঁর পিতাকে হারান। পিতার মৃত্যুতে তিনি নিদারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েন; কিন্তু সাহস হারাননি। জ্ঞান লাভের প্রতি ছিল তাঁর খুব আগ্রহ। তৎকালীন যুগের বিখ্যাত আলেম হজরত আহমদ ইবনে মুহাম্মদ বারকানী এবং হজরত আবু নসর ইসমাইলের কাছে তিনি কোরআন, হাদিস, ফিকাহ ও বিবিধ বিষয়ে অস্বাভাবিক জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু এতে তিনি তৃপ্তি বোধ করলেন না। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য পাগলের মতো ছুটে যান নিশাপুরের নিজামিয়া মাদ্রাসায়। তৎকালীন যুগে নিশাপুর ছিল ইসলামী জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে সমৃদ্ধ ও উন্নত। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সর্বপ্রথম ও পৃথিবীর বৃহৎ নিজামিয়া মাদ্রাসা। সেখানে তিনি ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুল মালিক (রহ.)-এর কাছে ইসলামী দর্শন, আইন ও বিবিধ বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন।
আবদুল মালিক (রহ.)-এর মৃত্যুর পর তিনি চলে আসেন বাগদাদে। এখানে এসে তিনি একটি মাদ্রাসায় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হোন এবং বিভিন্ন জটিল বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনে তাঁর সুখ্যাতি আস্তে আস্তে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে তিনি আল্লাহকে পাওয়ার জন্য এবং আল্লাহর সৃষ্টির রহস্যের সন্ধানে ধনসম্পদ ও ঘরবাড়ির মায়া-মমতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অজানা এক পথে। প্রায় ১০টি বছর দরবেশের বেশে ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। আল্লাহর ইবাদত, ধ্যানমগ্ন, শিক্ষাদান ও জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেন দিন-রাত। জেরুজালেম হয়ে চলে যান মদিনায়। বিশ্বনবীর রওজা মোবারক জিয়ারত করে শেষে চলে আসেন মক্কায়। হজব্রত পালন করেন। এর পর চলে যান আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেখানে কিছু দিন অবস্থান করে আবার ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে।
হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক জ্ঞান ছিল অত্যন্ত গভীর। আল্লাহর স্বরূপ ও সৃষ্টির রহস্য তিনি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর মতে, আত্মা ও সৃষ্টির রহস্য এবং আল্লাহর অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কে মীমাংসা করার বিষয় নয়। বরং এরূপ চেষ্টা করাও অন্যায়। আল্লাহর অস্তিত্ব ও সৃষ্টির রহস্য অনুভূতির বিষয়। পরম সত্য ও অনন্তকে যুক্তি দিয়ে বোঝার কোনো অবকাশ নেই। তাঁর মতে, যুক্তি দিয়ে আপেক্ষিকতা বোঝা যায় মাত্র। তিনি সব প্রশ্নে মীমাংসা করেছেন কোরআন, হাদিস ও নিজের বিবেক-বুদ্ধির সাহায্যে। আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল পর্বতের মতো অটল ও সুদৃঢ়। ধর্ম ও দর্শনে তাঁর ছিল প্রভূত জ্ঞান। ধর্ম ও যুক্তির নিজ নিজ বলয় তিনি নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'আত্মা কখনো ধ্বংস হয় না; কিন্তু দেহ ধ্বংস হয়। আত্মা মৃত্যুর পর জীবিত থাকে। হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে আত্মার কোনো সম্পর্ক নেই, হৃৎপিণ্ড একটি মাংসপিণ্ড মাত্র, মৃত্যুর পরও দেহে এর অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু আত্মা মৃতদেহে অবশিষ্ট থাকে না। মৃত্যুর পর আত্মার পরিপূর্ণ উৎকর্ষ ও মুক্তি সম্ভবপর হয়ে থাকে।' তিনি ইসলামী জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছেন।
হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.) ছিলেন ধর্ম, আদর্শ ও উন্নত নৈতিকগুণের মূর্তিমান প্রতীক। তিনি চাইতেন সবাই যেন প্রকৃত ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জীবন পরিচালিত করে। হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.) সমাজের নানাবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদ করে যেতেন। খোদাতায়ালার ইবাদতে তিনি দিনরাত মশগুল থাকতেন। লোকদের উপদেশ দিতেন এক খোদার ইবাদত করার, কখনো যেন খোদার সঙ্গে কাউকে অংশীদার না করেন। এ ছাড়া হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.) খুবই সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। মৃত্যুর দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন। তারপর নিজ হাতে তৈরি করা কাফনের কাপড়খানা বের করে বলেন, 'হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি তো রহমান এবং রহিম। হে আল্লাহ, একমাত্র তোমাকে পাওয়ার জন্য এবং তোমার স্বরূপ বোঝার জন্যই আমি সব আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে ঘুরে ফিরেছি বছরের পর বছর এবং এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তরে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।' এরপর তিনি কাফনের কাপড় পরিধান করেন এবং পা দুখানা সোজা করে শুয়ে পড়েন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিশ্ব বিখ্যাত এই আউলিয়া ও ধর্মসংস্কারক চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন মুসলিম জাহানে।

No comments:

EID MUBARAK to everybody