আপডেট: ০১:১৭, আগস্ট ২৫, ২০১৬
| প্রিন্ট সংস্করণ
|
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে: ‘সিইং ইজ বিলিভিং’। সহজ বাংলায় বলা যায়,
দর্শনই বিশ্বাস। তাই মাঝেমধ্যে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো। ৭ থেকে ১৭ আগস্ট
রাশিয়ার বর্তমান রাজধানী মস্কো এবং জারদের ঐতিহাসিক রাজধানী সেন্ট
পিটার্সবার্গ গিয়েছিলাম। বহুদিন থেকে দেশটি দেখার ইচ্ছা পোষণ করছিলাম,
যদিও সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন আর নেই। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে
রাশিয়ার আমূল পরিবর্তনের প্রায় ৭৫ বছর পর আরেকবার রাশিয়ার পরিবর্তন হয়েছে।
বর্তমান রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র ও লেনিনবাদ নির্বাপিত। রাশিয়া পুঁজিবাদের
অনুসারী। আর তথাকথিত ডেমোক্রেসি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরও আয়তনে রাশিয়া
বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ।
বর্তমান রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র ও লেনিনবাদ নির্বাপিত। নতুন রাশিয়ায়, অন্তত আপাতদৃষ্টে, লেনিন ও কার্ল মার্ক্স বিসর্জিত।
রাশিয়ার এই দুই শহর সম্বন্ধে আমার যে ধারণা ছিল,
তা ছিল পশ্চিমা বিশ্বের পুঁজিবাদী প্রচারণায় অনেকটা আচ্ছন্ন। রাশিয়ার
ইতিহাস যৎসামান্য যা জেনেছিলাম, তা কিছুটা পুরোনো সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।
তবে এই কয়েক দিনের সফরে আমার ধারণা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়েছে, বিশেষ করে
বর্তমানের রাশিয়ার শক্তিমত্তা ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টার
ক্ষেত্রে।
মস্কোতে বিমান থেকে রাতে অবতরণের পরেও বুঝতে পারিনি, প্রায় ৮০০ বছর পুরোনো এই শহরে আমার জন্য বহু চমক রয়েছে। যদিও প্রধান বিমানবন্দর ১৯৪৮ সালের দোমাদেদোভা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন হলেও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের চিহ্ন অনেকটাই বিদ্যমান—বিশাল বিমানবন্দর, তবে ওই সময় তেমন একটা ভিড় ছিল না। ইমিগ্রেশন পার হতে অনেক সময় লেগেছিল। হয়তো বাংলাদেশের পাসপোর্টে এত মানুষের একসঙ্গে হাজির হওয়ার কারণে। প্রথমেই ভাষার সমস্যায় পড়তে হয়েছিল, তবে বড় ধরনের সমস্যা ছাড়াই গভীর রাতে মস্কোর কেন্দ্রের কয়েক কিলোমিটার বাইরে হোটেলে পৌঁছানোর পথে হাইওয়েতে গাড়ির এমনটা ভিড় আশা করিনি। এমন প্রশস্ত ও আলোকোজ্জ্বল সড়ক ইউরোপের বহু দেশেই দেখিনি।
পরদিন মস্কো দর্শন তথা পুরোনো মস্কো শহর, মস্ক্ভা নদীর দুপারের দৃশ্য দেখে হতবাক হওয়ার মতো। এত চওড়া রাস্তা আর রাস্তায় যানজট—সবই ছিল ধারণার বাইরে। সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি প্রধান সড়ক ভেলেস্কা উলিৎসাসহ অন্যান্য সড়কের দুই পাশের দালানগুলো একই আদলের। গাইডের কাছ থেকে যা জানলাম তা হলো, এসব রাস্তাঘাট সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা সোভিয়েত ইউনিয়নের আগের তৈরি। তবে অনেক বিশাল আকারের যেসব স্থাপনা সোভিয়েত আমলে তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর বিশালতা একধরনের অবাক হওয়ার মতো। রাতের মস্কো আরও আকর্ষণীয়। মস্কোর চারদিকে সার্কুলার রোড আর পুরোনো মস্কোর সব বড় সড়কের মিলনস্থল ক্রেমলিন ও রেড স্কয়ার।
সোভিয়েত সময়ের মস্কোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শক্তিকে দারুণভাবে দৃশ্যমান করার প্রচেষ্টা ছিল। তবে যা চোখে পড়েনি তা হলো লেনিনের উপস্থিতি, যা একসময় মস্কোর প্রতিটি প্রধান সংযোগস্থলে দৃশ্যমান ছিল। শত শত লেনিনমূর্তি শহর থেকে উধাও—দু-একটি যা–ও রয়েছে তা–ও বেশ অরক্ষিত; শুধু রেড স্কয়ারের লেনিনের সমাধি ছাড়া। যে লেনিন বিশ্বকে তাঁর তত্ত্বের মাধ্যমে উজ্জীবিত করেছিলেন, তিনিই তাঁর দেশের রাজধানী থেকে প্রায় উধাও। আর কার্ল মার্ক্স তো রাশিয়ার মাটিতেই নেই। লেনিনের সমাধি, যেখানে লেনিনের শরীর মমি করে সংরক্ষিত, এখনো পর্যটকদের আকর্ষণস্থল।
বর্তমানে রাশিয়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকলেও দুমাতে মাত্র চারটি দলের উপস্থিতি। ‘ইউনাইটেট রাশিয়া’ পার্টি ৪৫০ আসনবিশিষ্ট দুমায় ২৩৮টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে। তারপরই ১৯ শতাংশ ভোটের মাধ্যমে ৯২টি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দলে রয়েছে একসময়ের প্রতাপশালী কমিউনিস্ট পার্টি, বর্তমান নাম ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী এই দলের অভ্যন্তরে রয়েছে যথেষ্ট মতভেদ। অনেকে দল বদল করে সরকারি দলে যোগদান করছেন। মস্কো অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির তেমন দাপট নেই, এমনকি ‘স্তারায়া প্লোশিদ’-এর প্রধান দপ্তরটিও হাতছাড়া হয়েছে বরিস ইয়েলৎসিনের সময় থেকে। ওই সময়ে মূল দলটি নিষিদ্ধ হয়। এখনকার রাশিয়া ভ্লাদিমির পুতিনময়, যদিও ক্রেমলিন বা রেড স্কয়ারে পুতিনের বিলবোর্ড বা মূর্তি কিংবা ছবি নজরে পড়েনি। এমনকি পুরোনো লেনিনগ্রাদ বর্তমানের সেন্ট পিটার্সবার্গেও চোখে পড়েনি। রেডিও-টিভিতেও তেমন দৃশ্যমান নয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে রাশিয়া অনেক পরিবর্তিত। বিশাল সব শপিং সেন্টার শহরজুড়ে—যুক্তরাষ্ট্রের ফাস্টফুড ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি ও বার্গার কিংয়ে ভর্তি। সব সময় তরুণ রাশিয়ানদের ভিড় লেগে রয়েছে এসব দোকানে। দুটি শহরেই একই দৃশ্য। বড় শপিং মলগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নামীদামি ব্র্যান্ডের দোকান। ‘মেইড ইন রাশিয়া’ কিছু কিনতে হলে খুঁজতে হবে অনেক সময় ধরে।
আমাদের প্রজন্মের জন্মলগ্ন থেকেই ক্রেমলিন ও রেড স্কয়ার সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সঙ্গে একাকার মনে হতো, বাস্তবে তেমনটা নয়। ক্রেমলিন পুরোনো রাজকীয় রাশিয়ার, বিশেষ করে ‘রোমানভ’ সাম্রাজ্যের আগেই রাজধানীর প্রধান কেন্দ্র হিসেবে দেয়ালঘেরা প্রশাসনিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মাঝখানে রাজপ্রাসাদ, যা বর্তমানে প্রেসিডেন্টের অন্যতম দপ্তর। প্রাসাদ চত্বরে রয়েছে একাধিক রাশিয়ান অর্থডক্স ও খ্রিষ্টান গির্জা, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে বন্ধ ছিল; এখন খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রধান গির্জায় ক্রেমলিনবাসীর জন্য প্রার্থনা করা হয়। সোভিয়েত আমলে রাশিয়াব্যাপী উপাসনালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। গির্জার অঢেল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই রাশিয়ায় ক্রমেই গির্জার প্রভাব বাড়ছে, যদিও অনেক গির্জা এখনো জাদুঘর হিসেবেই রয়ে গেছে। রেড স্কয়ারের মাথায় সেন্ট বাসিল ক্যাথেড্রাল, যা মস্কোর সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক গির্জা, এখন প্রার্থনায় সরগরম থাকে। ওই গির্জায় রয়েছে বিখ্যাত ‘অনিয়ন ডোম’ বা পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজচূড়া।
আমাদের ধারণা ছিল, ‘রেড স্কয়ার’ মানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের প্রতীক। তেমন নয়। রেড স্কয়ার মানে ‘সুন্দর চত্বর’, যা মস্কো শহরের প্রধান চত্বর। এক কোনায় লেনিনের সমাধি। অপর পাশে বিশাল আকারের শপিং মল। এখানেই বিপ্লব দিবসের কুচকাওয়াজ হতো। এখন রাশিয়ার জাতীয় দিবস ১২ জুন উদ্যাপিত হয় কুচকাওয়াজের মাধ্যমে। রেড স্কয়ার, যার সঙ্গে রেড রাশিয়ার সম্পর্ক নেই। নেই বৃহৎ আকারের লেনিনের প্রমাণ সাইজের মূর্তি। দুই.
রাশিয়ান ফেডারেশন, বহু বছর ধরেই যার নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। বর্তমানে তিনি দেশের চেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশি চর্চিত। তিনি সীমিত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বড় বড় শহরে পুতিনবিরোধী দলের কার্যক্রম সীমিত, মস্কোতে তো নয়ই। কমিউনিস্ট পার্টির ১৯ শতাংশের সমর্থন বড় শহরগুলোর বাইরে। বর্তমান প্রজন্ম রাশিয়ার গৌরবময় প্রাক্-সমাজতান্ত্রিক ইতিহাস নিয়ে উচ্ছ্বসিত। সেন্ট পিটার্সবার্গের ৬২টি রাজকীয় প্রাসাদের চাকচিক্য আর চমক দেখতে ভিড় জমানো রাশিয়ান আর পর্যটকদের উপস্থিতি, গাইডদের মুখে জারদের কাহিনির উচ্ছ্বসিত বিবরণ, যার উপস্থিতি এবং প্রভাব বিশেষ করে পিটার দ্য গ্রেট ও ক্যাথরিন দ্য গ্রেট ঐতিহাসিক এই রাজপ্রাসাদগুলোতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাস আর বর্তমান রাশিয়া নিয়ে উচ্ছ্বসিত। অনেকের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিনগুলো ছিল দুঃস্বপ্ন। অপর দিকে ওই সময়কার প্রজন্ম এখনো পরিবর্তনের সঙ্গে তেমন খাপ খাওয়াতে পারছে বলে মনে হয়নি।
রাশিয়াতে শুধু গির্জার পুনরুত্থান হয়নি, বরং ‘প্রাক্-সোভিয়েত ইউনিয়ন’ রাশিয়ার মূল্যায়ন হচ্ছে নতুনভাবে। রাশিয়ার শেষ জার, দ্বিতীয় নিকোলাস তাঁর স্ত্রী জারিনা আলেকসান্দ্রা ও পাঁচ সন্তান, যাঁরা ১৯১৮ সালে বলশেভিকদের হাতে খুন হয়েছিলেন, তাঁদের দেহাবশেষ, বিশেষ করে জার ও জারিনার, ইকাতেরিনবুর্গ, উরাল অঞ্চল থেকে নিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে পুনঃসমাধিস্থ করে ১৫ আগস্ট ২০০০ সালে রাশিয়ার অর্থডক্স গির্জা সর্বসম্মতিতে পুরো পরিবারকে ‘সেন্ট’ হিসেবে ঘোষিত করে। এরই প্রেক্ষাপটে ২০০৮ সালে রাশিয়ান ফেডারেশনের সুপ্রিম কোর্ট তাদের রুলিংয়ে বলেন যে সম্পূর্ণ নিকোলাস পরিবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের সমাধি বর্তমানে পিটার্সবার্গের সেন্ট ক্যাথরিন গির্জায় আলাদা কক্ষে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ওই গির্জায় ভিড় জমান। বর্তমানের রাশিয়া রোমানভ পরিবারের এই শেষ নৃপতির প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
তিন.
বর্তমান রাশিয়ার নেতা ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে সোভিয়েত স্টাইলের খুব একটা বাইরে গেছেন বলে মনে হয় না। রাশিয়া আজও প্রায় পুলিশ স্টেট, কেজিবির নাম পরিবর্তন হয়ে এফএসবি হয়েছে। পুরোনো কেজিবি সদর দপ্তরেই পুনর্গঠিত হয় এফএসবি। এই সংস্থা সরাসরি রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে কর্মপরিচালনা করে। ভ্লাদিমির পুতিন একসময় কেজিবির আঞ্চলিক কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়াল অপসারণ পর্যন্ত পূর্ব জার্মানিতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯১ সালে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কাজেই বর্তমান এফএসবি কর্মপন্থা নির্ণয়ে তাঁর প্রভাব বিস্তর।
পুতিনের রাষ্ট্রপরিচালনার স্টাইলকে তাঁর বিপক্ষের মানুষ পুরোনো জারদের স্টাইল বলে মনে করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেকে পুতিনকে রাশিয়ার জার বলে সম্বোধন করেন। পুতিনের ক্রেমলিন অফিস সাবেক জারদের প্রাসাদ। তথ্যে প্রকাশ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে হালের সামরিক অভ্যুত্থানের আগাম তথ্য এফএসবির মাধ্যমে তাঁকে জানানো হয়েছিল। এরই প্রেক্ষাপটে এরদোয়ান ৯ আগস্ট রাশিয়া সফর করেন। পুতিন ক্রমেই রাশিয়াকে বিশ্বমঞ্চের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় রত। এবং এ কারণেই সিরিয়ার বাশার আল-আসাদকে টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। রাশিয়া আর ইরানের অবস্থান একই হওয়াতে পরস্পরের কৌশলগত যোগাযোগ কতখানি বেড়েছে, তার প্রমাণ সিরিয়ায় বাশারবিরোধীদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিমান হামলায় ইরানি ভূখণ্ড ব্যবহার। অন্যদিকে তুরস্কের সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ায় সিরিয়া সরকারকে আরও শক্তি জোগানো সম্ভব হবে। সিরিয়ার ব্যাপারে পুতিনের হঠাৎ সক্রিয় অবস্থানকে অনেক বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনের পর সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অধিক তৎপরতার সম্ভাবনাকে সীমিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরানের সঙ্গে এই যোগাযোগের আরও কৌশলগত দিক রয়েছে। এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
চার.
এই সংক্ষিপ্ত সফরে যা দৃশ্যমান ছিল, তা হলো নতুন রাশিয়ার উত্থান। নতুন রাশিয়ায়, অন্তত আপাতদৃষ্টে, লেনিন ও কার্ল মার্ক্স বিসর্জিত। লেনিনের সমাধি অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনার মতো দর্শনীয় স্থানমাত্র। তাত্ত্বিক দিক থেকে না হলেও রাশিয়া পুরোনো ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে নতুন আঙ্গিকে পশ্চিমা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত। অন্তত সিরিয়া ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতে তেমনটাই দৃশ্যমান।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
http://www.prothom-alo.com/opinion/article/956812
মস্কোতে বিমান থেকে রাতে অবতরণের পরেও বুঝতে পারিনি, প্রায় ৮০০ বছর পুরোনো এই শহরে আমার জন্য বহু চমক রয়েছে। যদিও প্রধান বিমানবন্দর ১৯৪৮ সালের দোমাদেদোভা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন হলেও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের চিহ্ন অনেকটাই বিদ্যমান—বিশাল বিমানবন্দর, তবে ওই সময় তেমন একটা ভিড় ছিল না। ইমিগ্রেশন পার হতে অনেক সময় লেগেছিল। হয়তো বাংলাদেশের পাসপোর্টে এত মানুষের একসঙ্গে হাজির হওয়ার কারণে। প্রথমেই ভাষার সমস্যায় পড়তে হয়েছিল, তবে বড় ধরনের সমস্যা ছাড়াই গভীর রাতে মস্কোর কেন্দ্রের কয়েক কিলোমিটার বাইরে হোটেলে পৌঁছানোর পথে হাইওয়েতে গাড়ির এমনটা ভিড় আশা করিনি। এমন প্রশস্ত ও আলোকোজ্জ্বল সড়ক ইউরোপের বহু দেশেই দেখিনি।
পরদিন মস্কো দর্শন তথা পুরোনো মস্কো শহর, মস্ক্ভা নদীর দুপারের দৃশ্য দেখে হতবাক হওয়ার মতো। এত চওড়া রাস্তা আর রাস্তায় যানজট—সবই ছিল ধারণার বাইরে। সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি প্রধান সড়ক ভেলেস্কা উলিৎসাসহ অন্যান্য সড়কের দুই পাশের দালানগুলো একই আদলের। গাইডের কাছ থেকে যা জানলাম তা হলো, এসব রাস্তাঘাট সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা সোভিয়েত ইউনিয়নের আগের তৈরি। তবে অনেক বিশাল আকারের যেসব স্থাপনা সোভিয়েত আমলে তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর বিশালতা একধরনের অবাক হওয়ার মতো। রাতের মস্কো আরও আকর্ষণীয়। মস্কোর চারদিকে সার্কুলার রোড আর পুরোনো মস্কোর সব বড় সড়কের মিলনস্থল ক্রেমলিন ও রেড স্কয়ার।
সোভিয়েত সময়ের মস্কোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শক্তিকে দারুণভাবে দৃশ্যমান করার প্রচেষ্টা ছিল। তবে যা চোখে পড়েনি তা হলো লেনিনের উপস্থিতি, যা একসময় মস্কোর প্রতিটি প্রধান সংযোগস্থলে দৃশ্যমান ছিল। শত শত লেনিনমূর্তি শহর থেকে উধাও—দু-একটি যা–ও রয়েছে তা–ও বেশ অরক্ষিত; শুধু রেড স্কয়ারের লেনিনের সমাধি ছাড়া। যে লেনিন বিশ্বকে তাঁর তত্ত্বের মাধ্যমে উজ্জীবিত করেছিলেন, তিনিই তাঁর দেশের রাজধানী থেকে প্রায় উধাও। আর কার্ল মার্ক্স তো রাশিয়ার মাটিতেই নেই। লেনিনের সমাধি, যেখানে লেনিনের শরীর মমি করে সংরক্ষিত, এখনো পর্যটকদের আকর্ষণস্থল।
বর্তমানে রাশিয়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকলেও দুমাতে মাত্র চারটি দলের উপস্থিতি। ‘ইউনাইটেট রাশিয়া’ পার্টি ৪৫০ আসনবিশিষ্ট দুমায় ২৩৮টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে। তারপরই ১৯ শতাংশ ভোটের মাধ্যমে ৯২টি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দলে রয়েছে একসময়ের প্রতাপশালী কমিউনিস্ট পার্টি, বর্তমান নাম ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী এই দলের অভ্যন্তরে রয়েছে যথেষ্ট মতভেদ। অনেকে দল বদল করে সরকারি দলে যোগদান করছেন। মস্কো অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির তেমন দাপট নেই, এমনকি ‘স্তারায়া প্লোশিদ’-এর প্রধান দপ্তরটিও হাতছাড়া হয়েছে বরিস ইয়েলৎসিনের সময় থেকে। ওই সময়ে মূল দলটি নিষিদ্ধ হয়। এখনকার রাশিয়া ভ্লাদিমির পুতিনময়, যদিও ক্রেমলিন বা রেড স্কয়ারে পুতিনের বিলবোর্ড বা মূর্তি কিংবা ছবি নজরে পড়েনি। এমনকি পুরোনো লেনিনগ্রাদ বর্তমানের সেন্ট পিটার্সবার্গেও চোখে পড়েনি। রেডিও-টিভিতেও তেমন দৃশ্যমান নয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে রাশিয়া অনেক পরিবর্তিত। বিশাল সব শপিং সেন্টার শহরজুড়ে—যুক্তরাষ্ট্রের ফাস্টফুড ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি ও বার্গার কিংয়ে ভর্তি। সব সময় তরুণ রাশিয়ানদের ভিড় লেগে রয়েছে এসব দোকানে। দুটি শহরেই একই দৃশ্য। বড় শপিং মলগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নামীদামি ব্র্যান্ডের দোকান। ‘মেইড ইন রাশিয়া’ কিছু কিনতে হলে খুঁজতে হবে অনেক সময় ধরে।
আমাদের প্রজন্মের জন্মলগ্ন থেকেই ক্রেমলিন ও রেড স্কয়ার সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সঙ্গে একাকার মনে হতো, বাস্তবে তেমনটা নয়। ক্রেমলিন পুরোনো রাজকীয় রাশিয়ার, বিশেষ করে ‘রোমানভ’ সাম্রাজ্যের আগেই রাজধানীর প্রধান কেন্দ্র হিসেবে দেয়ালঘেরা প্রশাসনিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মাঝখানে রাজপ্রাসাদ, যা বর্তমানে প্রেসিডেন্টের অন্যতম দপ্তর। প্রাসাদ চত্বরে রয়েছে একাধিক রাশিয়ান অর্থডক্স ও খ্রিষ্টান গির্জা, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে বন্ধ ছিল; এখন খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রধান গির্জায় ক্রেমলিনবাসীর জন্য প্রার্থনা করা হয়। সোভিয়েত আমলে রাশিয়াব্যাপী উপাসনালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। গির্জার অঢেল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই রাশিয়ায় ক্রমেই গির্জার প্রভাব বাড়ছে, যদিও অনেক গির্জা এখনো জাদুঘর হিসেবেই রয়ে গেছে। রেড স্কয়ারের মাথায় সেন্ট বাসিল ক্যাথেড্রাল, যা মস্কোর সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক গির্জা, এখন প্রার্থনায় সরগরম থাকে। ওই গির্জায় রয়েছে বিখ্যাত ‘অনিয়ন ডোম’ বা পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজচূড়া।
আমাদের ধারণা ছিল, ‘রেড স্কয়ার’ মানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের প্রতীক। তেমন নয়। রেড স্কয়ার মানে ‘সুন্দর চত্বর’, যা মস্কো শহরের প্রধান চত্বর। এক কোনায় লেনিনের সমাধি। অপর পাশে বিশাল আকারের শপিং মল। এখানেই বিপ্লব দিবসের কুচকাওয়াজ হতো। এখন রাশিয়ার জাতীয় দিবস ১২ জুন উদ্যাপিত হয় কুচকাওয়াজের মাধ্যমে। রেড স্কয়ার, যার সঙ্গে রেড রাশিয়ার সম্পর্ক নেই। নেই বৃহৎ আকারের লেনিনের প্রমাণ সাইজের মূর্তি। দুই.
রাশিয়ান ফেডারেশন, বহু বছর ধরেই যার নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। বর্তমানে তিনি দেশের চেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশি চর্চিত। তিনি সীমিত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বড় বড় শহরে পুতিনবিরোধী দলের কার্যক্রম সীমিত, মস্কোতে তো নয়ই। কমিউনিস্ট পার্টির ১৯ শতাংশের সমর্থন বড় শহরগুলোর বাইরে। বর্তমান প্রজন্ম রাশিয়ার গৌরবময় প্রাক্-সমাজতান্ত্রিক ইতিহাস নিয়ে উচ্ছ্বসিত। সেন্ট পিটার্সবার্গের ৬২টি রাজকীয় প্রাসাদের চাকচিক্য আর চমক দেখতে ভিড় জমানো রাশিয়ান আর পর্যটকদের উপস্থিতি, গাইডদের মুখে জারদের কাহিনির উচ্ছ্বসিত বিবরণ, যার উপস্থিতি এবং প্রভাব বিশেষ করে পিটার দ্য গ্রেট ও ক্যাথরিন দ্য গ্রেট ঐতিহাসিক এই রাজপ্রাসাদগুলোতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাস আর বর্তমান রাশিয়া নিয়ে উচ্ছ্বসিত। অনেকের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিনগুলো ছিল দুঃস্বপ্ন। অপর দিকে ওই সময়কার প্রজন্ম এখনো পরিবর্তনের সঙ্গে তেমন খাপ খাওয়াতে পারছে বলে মনে হয়নি।
রাশিয়াতে শুধু গির্জার পুনরুত্থান হয়নি, বরং ‘প্রাক্-সোভিয়েত ইউনিয়ন’ রাশিয়ার মূল্যায়ন হচ্ছে নতুনভাবে। রাশিয়ার শেষ জার, দ্বিতীয় নিকোলাস তাঁর স্ত্রী জারিনা আলেকসান্দ্রা ও পাঁচ সন্তান, যাঁরা ১৯১৮ সালে বলশেভিকদের হাতে খুন হয়েছিলেন, তাঁদের দেহাবশেষ, বিশেষ করে জার ও জারিনার, ইকাতেরিনবুর্গ, উরাল অঞ্চল থেকে নিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে পুনঃসমাধিস্থ করে ১৫ আগস্ট ২০০০ সালে রাশিয়ার অর্থডক্স গির্জা সর্বসম্মতিতে পুরো পরিবারকে ‘সেন্ট’ হিসেবে ঘোষিত করে। এরই প্রেক্ষাপটে ২০০৮ সালে রাশিয়ান ফেডারেশনের সুপ্রিম কোর্ট তাদের রুলিংয়ে বলেন যে সম্পূর্ণ নিকোলাস পরিবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের সমাধি বর্তমানে পিটার্সবার্গের সেন্ট ক্যাথরিন গির্জায় আলাদা কক্ষে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ওই গির্জায় ভিড় জমান। বর্তমানের রাশিয়া রোমানভ পরিবারের এই শেষ নৃপতির প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
তিন.
বর্তমান রাশিয়ার নেতা ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে সোভিয়েত স্টাইলের খুব একটা বাইরে গেছেন বলে মনে হয় না। রাশিয়া আজও প্রায় পুলিশ স্টেট, কেজিবির নাম পরিবর্তন হয়ে এফএসবি হয়েছে। পুরোনো কেজিবি সদর দপ্তরেই পুনর্গঠিত হয় এফএসবি। এই সংস্থা সরাসরি রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে কর্মপরিচালনা করে। ভ্লাদিমির পুতিন একসময় কেজিবির আঞ্চলিক কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়াল অপসারণ পর্যন্ত পূর্ব জার্মানিতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯১ সালে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কাজেই বর্তমান এফএসবি কর্মপন্থা নির্ণয়ে তাঁর প্রভাব বিস্তর।
পুতিনের রাষ্ট্রপরিচালনার স্টাইলকে তাঁর বিপক্ষের মানুষ পুরোনো জারদের স্টাইল বলে মনে করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেকে পুতিনকে রাশিয়ার জার বলে সম্বোধন করেন। পুতিনের ক্রেমলিন অফিস সাবেক জারদের প্রাসাদ। তথ্যে প্রকাশ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে হালের সামরিক অভ্যুত্থানের আগাম তথ্য এফএসবির মাধ্যমে তাঁকে জানানো হয়েছিল। এরই প্রেক্ষাপটে এরদোয়ান ৯ আগস্ট রাশিয়া সফর করেন। পুতিন ক্রমেই রাশিয়াকে বিশ্বমঞ্চের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় রত। এবং এ কারণেই সিরিয়ার বাশার আল-আসাদকে টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। রাশিয়া আর ইরানের অবস্থান একই হওয়াতে পরস্পরের কৌশলগত যোগাযোগ কতখানি বেড়েছে, তার প্রমাণ সিরিয়ায় বাশারবিরোধীদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিমান হামলায় ইরানি ভূখণ্ড ব্যবহার। অন্যদিকে তুরস্কের সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ায় সিরিয়া সরকারকে আরও শক্তি জোগানো সম্ভব হবে। সিরিয়ার ব্যাপারে পুতিনের হঠাৎ সক্রিয় অবস্থানকে অনেক বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনের পর সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অধিক তৎপরতার সম্ভাবনাকে সীমিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরানের সঙ্গে এই যোগাযোগের আরও কৌশলগত দিক রয়েছে। এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
চার.
এই সংক্ষিপ্ত সফরে যা দৃশ্যমান ছিল, তা হলো নতুন রাশিয়ার উত্থান। নতুন রাশিয়ায়, অন্তত আপাতদৃষ্টে, লেনিন ও কার্ল মার্ক্স বিসর্জিত। লেনিনের সমাধি অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনার মতো দর্শনীয় স্থানমাত্র। তাত্ত্বিক দিক থেকে না হলেও রাশিয়া পুরোনো ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে নতুন আঙ্গিকে পশ্চিমা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত। অন্তত সিরিয়া ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতে তেমনটাই দৃশ্যমান।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
http://www.prothom-alo.com/opinion/article/956812
No comments:
Post a Comment