|
আপডেট: ০০:২৮, নভেম্বর ২০, ২০১৫
| প্রিন্ট সংস্করণ
পারস্য ও আরব গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া বিষাদ-সিন্ধু বিরচিত হইল। প্রাচীন কাব্য-গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ করিয়া প্রাচীন কবিগণের রচনাকৌশল এবং শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষÿা করা অত্য¯ন্ত দুরূহ। মাদৃশ লোকের পেÿক্ষ তদ্বিষয়ের যথার্থ গৌরব রক্ষার আকাঙ্ক্ষা “বামনের বিধু-ধারণের আকাঙ্ক্ষা
বিষাদ-সিন্ধু
বাঙালি মুসলমানের লেখা প্রথম চিরায়ত উপন্যাস। প্রসাদগুণেও এ উপন্যাস
অনন্য। বইটি অচিরেই বেরোচ্ছে ইংরেজি অনুবাদে। এর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের
জন্মমাসে উপন্যাসটি অনুবাদের অভিজ্ঞতা লিখেছেন এর অনুবাদক
যত
দূর মনে পড়ে, মীর মশাররফ হোসেনের ধ্রুপদি উপন্যাস বিষাদ-সিন্ধু পড়েছিলাম
ছেলেবেলায়। তবে তা ছিল সংক্ষেপিত সংস্করণ। পুরো উপন্যাসটি পড়েছি আরও পরে,
একেবারে পরিণত বয়সে—সে-ও অনুবাদ করার সূত্রে। বছর দুয়েক আগের কথা। বাংলা
একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায়
অনুবাদ করতে বললেন আমাকে। তাঁর কথায় রাজিও হয়ে গেলাম। এরপর প্রথমেই পড়তে
শুরু করলাম গোটা উপন্যাস। এখানে বলে রাখা ভালো, বাংলা ভাষায় বিষাদ-সিন্ধুর
বেশ কয়েকটি সংস্করণ রয়েছে, তবে ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে বাংলা মূল গ্রন্থ
হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছি আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত সংস্করণটি। কারণ,
বিষাদ-সিন্ধুর অনেকগুলো সংস্করণের মধ্যে এটিকে আমার স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে
হয়েছে। যা হোক, উপন্যাস পড়া শেষে মনে হলো, আমার জন্য এটি অনুবাদ করা বামন
হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার মতো ব্যাপার হবে। প্রসঙ্গত বিষাদ-সিন্ধুতে প্রায়
এভাবেই লিখেছিলেন মীর মশাররফ হোসেন: ‘পারস্য ও আরব গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার
সারাংশ লইয়া বিষাদ-সিন্ধু বিরচিত হইল। প্রাচীন কাব্য-গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ
করিয়া প্রাচীন কবিগণের রচনাকৌশল এবং শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষÿা করা
অত্য¯ন্ত দুরূহ। মাদৃশ লোকের পেÿক্ষ তদ্বিষয়ের যথার্থ গৌরব রক্ষার
আকাঙ্ক্ষা “বামনের বিধু-ধারণের আকাঙ্ক্ষা” বলিতে হইবে। তবে মহর্রমের মূল
ঘটনাটি বঙ্গভাষাপ্রিয়-প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণের সহজে হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দেওয়াই
আমার একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য।’ কিন্তু আজ এত বছর পর আমি এখানে আবার কেন
লিখছি বামন ও চাঁদের প্রসঙ্গ, তার পুরো অর্থ আমার অনুবাদ-অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা
করলে পাঠকদের কাছে স্পষ্ট হবে হয়তো।উপন্যাসের মূল গল্পটি তো সবার জানা, থিমগুলোও পাঠকদের কাছে স্পষ্ট। তাই অনুবাদের শুরুতে প্রথমেই বোঝার চেষ্টা করলাম, ঔপন্যাসিক হিসেবে মীর মশাররফ হোসেন কী কী কৌশল প্রয়োগ করেছেন এখানে। দেখলাম, লেখক হিসেবে তিনি সচেতনভাবে অনেক কৌশল ব্যবহার করেছেন। পুরো আখ্যানের নানান ভাগ আছে। একদিকে এটি মহাকাব্যিক উপন্যাস, অন্যদিকে খানিকটা আঞ্চলিকও। আবার সর্বোপরি এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। উপন্যাসজুড়ে একের পর এক যেমন নাটকীয় মুহূর্তে আছে, তেমনি এর কোনো কোনো জায়গা খুব বেশি কাব্যময়। ইংরেজি অনুবাদে সেই নাটকীয়তা ও কাব্যময়তা যাতে বজায় থাকে, সে বিষয়ে আমি সব সময় সচেতন ছিলাম। তবে কাজটি করতে গিয়ে কতটুকু মান বজায় রাখতে পেরেছি, তা হয়তো সময়ান্তরে বোঝা যাবে। এককথায়, আলোচ্য উপাখ্যানে মীর মশাররফ হোসেন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির ছিলেন না; উপরন্তু একের ভেতর অনেক কিছুর সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ফলে অনুবাদ করতে গিয়ে প্রথমত এ বিষয়গুলো বুঝতে হয়েছে আমাকে এবং অনুবাদের সময় আমিও সচেতনভাবে ঔপন্যাসিকের মূল উদ্দেশ্যের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি।
এবার বলা যাক ঔপন্যাসিকের মহাকাব্যিক ভাষার কথা। বিষাদ-সিন্ধুতে মীর মশাররফ হোসেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভাষাশৈলী নির্মাণ করেছেন। ভাষার কাব্যময়তাকে বজায় রেখেছেন আগাগোড়া। অনুবাদক হিসেবে লেখকের এই সচেতনতাকে শ্রদ্ধা না দেখিয়ে উপায় নেই। স্বীকার করছি, শব্দের ব্যঞ্জনা বোঝাতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। যেহেতু এটি উনিশ শতকের একটি ধ্রুপদি উপন্যাস, একই সঙ্গে এখানে রয়েছে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি এবং অনেক দুর্বোধ্য, অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে পাণ্ডুলিপিতে; ফলে উপন্যাসের মূল সুর অক্ষুণ্ন রাখতে গিয়ে বারবার অভিধানের সাহায্য নিতে হয়েছে আমাকে। এ ছাড়া লেখকের বাক্যগঠন-সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোর প্রতিও নজর দিতে হয়েছে। যদিও ধর্মীয় ও অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার অনুবাদের সময় কিছুটা কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কিছু কিছু জায়গায় কোনো কোনো বাক্য আছে দশ-পনেরো লাইন পর্যন্ত দীর্ঘ; এ ক্ষেত্রে ইংরেজি অনুবাদে দীর্ঘ বাক্যগুলোকে না ভেঙে হুবহু রাখার চেষ্টা করেছি। কেননা এতে বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা হয়। এভাবে নানা দিক ভেবেচিন্তে সম্পন্ন করেছি অনুবাদ।
কখনো কখনো মনে হয়েছে, এটি অনুবাদ করার জন্য এত পরিশ্রমের কী দরকার? পরক্ষণেই আবার মীর মশাররফ হোসেনের শক্তিমত্তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি। কারণ, বিষাদ-সিন্ধুর সুনিপুণ কৌশল আমাকে মুগ্ধ করেছে। একদিকে এখানে আছে ব্যক্তিগত জীবনের গল্প, অন্যদিকে সমাজের সামগ্রিক বিষয়ের বয়ান। কৌশলগত দিক চিন্তা করলে স্পষ্টই বোঝা যায়, ‘এপিক’ বা মহাকাব্যের গঠনশৈলী সম্পর্কে মীর মশাররফের পঠনপাঠন কতটা বিস্তৃত ছিল। হ্যাঁ, এ লেখায় ঘুরেফিরে বারবার উপন্যাসটির গঠনকৌশলের কথা বলতে হচ্ছে। যেমন, কোনো কোনো জায়গায় কাউকে সম্বোধন করে একটি বিশেষ অংশ লেখা হয়েছে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আপোস্ট্রফি’; আবার উপন্যাসের শেষ দিকে কিছু অনুতাপ বা অনুশোচনার অংশও আছে, ইংরেজি ভাষায় একে বলে ‘লেমেন্ট’। এসব বিষয় অনুধাবনে আমাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কারণ আমি বহুবছর ধরে সাহিত্য-অধ্যাপনায় নিয়োজিত; ফলে ‘এপিক’ পড়তে গিয়ে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো নিজে যেমন পড়েছি, পড়িয়েছি ছাত্রছাত্রীদেরও।
অনুবাদের অভিজ্ঞতা লিখতে বসে এ কথাও বলা জরুরি, কাজটি করতে করতে মনে হয়েছে, মীর মশাররফ প্রথমত যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিষাদ-সিন্ধু লেখা শুরু করেছিলেন, শেষ অবধি তাতে আর অনড় থাকেননি, বরং লিখতে লিখতে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন এবং হেঁটেছেন সেই নতুন পথ ধরে। ফলে উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে বিচিত্রতা বিদ্যমান।
এমন একটি বৈচিত্র্যময় বই অনুবাদ করতে পেরে শেষাবধি ভালো লেগেছে এ জন্য যে এই উপন্যাস কেবল কারবালার ঘটনা নয়, নিছক ইমাম হাসান-ইমাম হোসেনের গতানুগতিক কাহিনিও নয়; এটি উনিশ শতকের একটি বিখ্যাত ধ্রুপদি গ্রন্থ, যেখানে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার আলোকে উনিশ শতকের সমাজব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়-আশয় স্থান পেয়েছে। যেমন, উপন্যাসের এক জায়গায় শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার মতো ঘটনা চোখে পড়ে। সহজ করে বললে, উপনিবেশবিরোধী চেতনা এখানে বিষাদ-সিন্ধুকে একটি অন্যতর মাত্রা দিয়েছে।
মীর মশাররফ প্রথমত যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিষাদ-সিন্ধু লেখা শুরু করেছিলেন, শেষ অবধি তাতে আর অনড় থাকেননি
প্রথমেই বলেছি, উপন্যাসের অনুবাদটি ছিল ভীষণ শ্রমসাধ্য একটি ব্যাপার। কাজটি শেষ করে অনেকবার ভেবেছি, অনুবাদ না করলে এ বইয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়তো আমার অজানাই থাকত। কারণ, একজন অনুবাদকের দৃষ্টিতে এ বই পড়ার ফলে এর যতগুলো দিক আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছে, নিছক পাঠকের দৃষ্টিতে পড়লে হয়তো সেটি হতো না—এখন কথাটি বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি। এ প্রসঙ্গে আরেকটু যোগ করি, অনুবাদ মানে তো কেবল শব্দের অনুবাদ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দৃষ্টিভঙ্গি, স্বরভঙ্গি, মনোভঙ্গি ইত্যাদি বিস্তর বিষয়। মূলত কৌশলগত দিক ঠিক রেখে বিষাদ-সিন্ধুর মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ উপন্যাস অনুবাদ করা সত্যিই দুরূহ। এটুকু বলতে পারি, আমি সেই কঠিন কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করতে চেষ্টা করেছি।
ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে পাঠকের সুবিধা-অসুবিধার কথাও মাথায় ছিল আমার। বিষাদ-সিন্ধুর মূল অনুবাদ শেষ করার পর ভেবেছি গ্রন্থশেষে একটি শব্দ-নির্ঘণ্ট দেব, তবে কোনোভাবেই সেটি আকারে বড় হবে না। অনেক ক্ষেত্রে বেশি বড় হলে অজানা শব্দ জানতে গিয়ে পাঠক কেবল নির্ঘণ্টে চোখ বুলান। ফলে মূল পাণ্ডুলিপি থেকে মনোযোগ বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আমি চেষ্টা করেছি ‘পেঙ্গুইন’ থেকে প্রকাশিত ধ্রুপদি বইগুলোর আদলে মূল পাণ্ডুলিপির মধ্যেই অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা জুড়ে দিতে। আশা করি, এতে পাঠক অনেকাংশে নির্ভার বোধ করবেন। এর বাইরে প্রয়োজনবোধে অতিরিক্ত টীকা বা বিশ্লেষণ যুক্ত করার সুযোগ তো এখনো রয়েছেই।
অনুবাদ করতে গিয়ে বারবার মনে উঁকি দিয়েছে একটি প্রশ্ন—উনিশ শতকের একটি বই এই সময়ের পাঠেকর জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক? পরে প্রশ্নের পিষ্ঠে পেয়েছি উত্তরও—কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজ-সংস্কৃতির নানা দিক থেকেও বিষাদ-সিন্ধু প্রাসঙ্গিক ও চিরায়ত। উপন্যাসে শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ইঙ্গিত আছে, রয়েছে লেখকের স্বাধীনতার কথা এবং তথাকথিত সমাজের খোলস বদলের আভাস। এই প্রসঙ্গগুলো এখনো সমানভাবে উচ্চারিত আমাদের সমাজে।
আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বিষাদ-সিন্ধুর অনুবাদ আমি কেন করলাম? বলব, কাজটি করেছি নিজের দায়িত্ববোধ থেকে। কেননা, এই অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বপাঠক পরিচিত হবেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ একটি ধ্রুপদি গ্রন্থের সঙ্গে। সর্বোপরি পুরো অনুবাদের কাজ চলাকালে এ উপন্যাসের প্রাসঙ্গিতা আমি নানাভাবে উপলব্ধি করেছি। উনিশ ও বিশ শতকজুড়ে বাংলা সাহিত্যে এমন একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস বিরল। এসব নানান বিবেচনায় বইটিকে আমার যেমন উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে, তেমনি বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকের গুরুত্ব অনুধাবনে অন্য ভাষার পাঠককেও ইংরেজি অনুবাদটি সাহায্য করবে—আমার বিশ্বাস এমনই।
এই ইংরেজি অনুবাদ অচিরেই বই আকারে বের হবে বাংলা একাডেমি থেকে। এ ছাড়া দিল্লিভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা ‘সোশ্যাল সায়েন্স একাডেমি’ও এটি প্রকাশে সবিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছে। আশা করছি, দ্রুততম সময়ে তারাও ইংরেজি সংস্করণটি বাজারে আনবে। আর এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পাঠকমহলে পৌঁছে যাবে বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি গ্রন্থ বিষাদ-সিন্ধু—এই আশা বুকে বেঁধে রাখি।
http://www.prothom-alo.com/art-and-literature/article/688432/
No comments:
Post a Comment